admin || মুক্ত কলম সংবাদ
প্রকাশিত: ২৫ জুন, ২০২০ ১০:০০ অপরাহ্ণ
নাগরিক ভাবনাঃ মাদক দ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচার বিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস, অ্যাডভোকেট আবু মহী উদ্দীন। ২৬ জুনকে মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচার বিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস। করোনা জনীত কারণে এবারের এই দিবস নিরবে নিভৃতে পার হয়ে যাবে। আধুনিক বিশ্বে নিত্যনতুন আবিষ্কার মানব জীবনকে একদিকে যেমন দিয়েছে স্বাচ্ছন্দ্য ও গতিময়তা, অন্যদিকে তেমন সঞ্চারিত করেছে হতাশা ও উদ্বেগের। বর্তমান বিশ্বসভ্যতা যে কয়টি মারাত্মক সমস্যার সম্মুখীন, মাদকাসক্তি তার অন্যতম। মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ বিস্তারে বিশ্বব্যাপী আজ শঙ্কিত। মাদকের ভয়াবহ ছোবলে অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে বহু তরুণের তাজা প্রাণ। বিঘ্নিত হচ্ছে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন। তাই আন্তর্জাতিকভাবে মাদকের ভয়াবহতা রোধে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ কর্তৃক প্রতি বছর ২৬ জুনকে মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচারবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
মাদকদ্রব্য ও মাদকাসক্তিঃ মাদকদ্রব্য হচ্ছে সেসব বস্তু যা গ্রহণের ফলে স্নায়বিক বৈকল্যসহ নেশার সৃষ্টি হয়। সুনির্দিষ্ট সময় পর পর তা সেবনের দুর্বিনীত আসক্তি অনুভূত হয় এবং কেবল সেবন দ্বারাই সে তীব্র আসক্তি (সাময়িক) দূরীভূত হয়। এর কুপ্রভাব ও ভয়াবহতা মারাত্মক। বাংলাদেশ যেসব মাদকদ্রব্যের সেবন সর্বাধিক সেগুলো হলো গাঁজা, ফেনসিডিল, হেরোইন, রেকটিফাইড স্পিরিট, মদ, বিয়ার, তাঁড়ি, পঁচুই, ঘুমের ওষুধ, প্যাথেড্রিন ইনজেকশন সাম্প্রতিক কালে সহজলভ্য , সুলভ মুল্য , সহজে বহনযোগ্য এবং ব্যবসায়িক দিক থেকে লাভজনক ইয়াবা। এসব মাদকদ্রব্য গ্রহণ করে নেশা সৃষ্টিকে মাদকাসক্তি বলা হয়। বিশ্বাস্বাস্থ্য সংস্থার (ডঐঙ) মতে, মাদকাসক্তি হচ্ছে চিকিৎসা গ্রহণযোগ্য নয় এমন দ্রব্য অতিরিক্ত পরিমাণে ক্রমাগত বিক্ষিপ্তভাবে গ্রহণ করা এবং এসব দ্রব্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়া।
মাদকাসক্তির কারণঃ মাদকাসক্তির কারণ বহুবিধ। এ পর্যন্ত বিজ্ঞানী, গবেষক ও চিকিৎসকরা মাদকাসক্তির অন্তরালে যে কারণগুলো সক্রিয় বলে চিহ্নিত করেছেন সেগুলো হলো: ১) সঙ্গদোষ ২) কৌতূহল ৩) সহজ আনন্দ লাভের বাসনা ৪) প্রথম যৌবনের বিদ্রোহী মনোভাব ৫)মনস্তাত্বিক বিশৃঙ্খলা ৬) পারিবারিক কলহ ৭)পরিবারের অভ্যন্তরে মাদকের প্রভাব ৮)ধর্মীয় মূল্যবোধের বিচ্যুতি ৯) চিকিৎসাসৃষ্ট মাদকাসক্তি ১০) মাদকদ্রব্যের সহজলভ্যতা মাদকাসক্তিতে কারা বেশি আক্রান্ত: যেসব পরিবারে পারিবারিক বন্ধন শিথিল, মা-বাবা, ভাই-বোনের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা কম, সেসব পরিবারের সদস্যরাই বেশি মাদকাসক্ত হয়ে থাকে। বাংলাদেশে অধিকাংশ মাদকাসক্তের গড় বয়স ১৮-৩২ বছর। এটা আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যজনক। কারণ, এই সময়টিই জীবনের সোনালী সময়। এই সময়ই মানুষ পরিবার, দেশ, জাতি তথা বিশ্বের জন্য বেশি শ্রম দেয়।
মাদকাসক্তি ও বিপন্ন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম : বিশ্বব্যাপী মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার এবং চোরাচালানের মাধ্যমে এর ব্যাপক প্রসার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করেছে। মাদকের নিষ্ঠুর ছোবলে অকালে ঝরে যাচ্ছে বহু তাজা প্রাণ এবং অংকুরেই বিনষ্ট হচ্ছে বহু তরুণের সম্ভাবনাময় উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। মাদকদ্রব্য তরুন সমাজের এক বিরাট অংশকে অকর্মণ্য ও অচেতন করে তুলেছে, অবক্ষয় ঘটাচ্ছে মূল্যবোধের।
বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে মাদকাসক্তির ধ্বংসাত্মক প্রভাব নিয়ে নিচে আলোচনা করা হলোঃ
১ যুবসমাজের ওপর প্রভাব ২.সামাজিক বিশৃঙ্খলা ৩. অন্যান্য সামাজিক সমস্যার জন্ম দেয় ৪.অবৈধ ব্যবসা ৫.শারীরিক ও
মানসিক ক্ষতি ৬.নৈতিক অধঃপতন ৭.পারিবারিক ভাঙ্গন ও হতাশা বৃদ্ধি ৮.সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ অবক্ষয়
৯.অপরাধ প্রবণতার হার বৃদ্ধি।
১০ শিক্ষার ওপর প্রভাব : মাদকাসক্তি সমস্যা আমাদের দেশের শিক্ষার ওপরও ব্যাপক প্রভাব ফেলছে কারণ মাদসক্তির
প্রভাবে অনেক মেধাবী ও ভালো ছাত্রছাত্রী মাদকদ্রব্য গ্রহণ করে তাদের সুন্দর ও সুস্থ ছাত্রজীবনের অবসান ঘটিয়ে ক্রমে
মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। যারা ফিরে আসছে তারাও সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ফিরে আসতে পারছে না। সুতরাং দেখা যায়,
মাদকাসক্তি সমস্যা আমাদের দেশের শিক্ষার ওপরও মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। আমাদের প্রজন্ম ধংশের দ্বারপ্রান্তে
পৌছে গেছে। মাদকাসক্তি সমস্যা সমাধানের উপায় : বিশ্বজুড়ে মাদকাসক্তি একটি জটিল সামাজিক সমস্যা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করায় এ সমস্যা সমাধানের জন্য স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে কর্মসূচি গ্রহণ করা হচ্ছে। চলছে বিভিন্ন গবেষণা ও প্রতিরোধমূলক কর্মসূচি। প্রতিটি শাস্ত্র, বিষয় ও ধর্মে মাদককে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে এবং এর প্রতিকারে বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ইসলাম ধর্মের ঊষালগ্নে ও নবী করিম (স:)-এর মদিনা হিজরতের পর চিন্তাশীল সাহাবাগণ মাদকের ক্ষতিকারক বিভিন্ন দিক নিয়ে ভাবতে থাকেন। বিষয়টি তারা নবীজীর নজরে আনেন। এ সময়ে মাদকের প্রতিরোধ প্রতিকার ও ক্ষতিকারক বিভিন্ন দিক সম্পর্কে
একাধিক আয়াত নাজিল হয়। যেমনঃ-
১.হে ঈমানদারগণ নেশাগ্রস্থ অবস্থায় নামাজের ধারে কাছেও যেও না।
২.হে মুমিনগণ, এই যে মদ, জুয়া, প্রতিমা ও ভাগ্য নির্ধারক শিরকসমূহ এসব শয়তানের কার্য বৈ তো নয়। অতএব এগুলো থেকে বেঁচে থাক, যাতে তোমরা কল্যাণপ্রাপ্ত হও।
৩.তারা তোমাকে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। বলে দাও, এতদুভয়ের মধ্যে রয়েছে মহাপাপ, আর মানুষের জন্য
উপকারিতাও রয়েছে, তবে মানুষের জন্য যে উপকারিতা রয়েছে এগুলোর পাপ উপকারিতা অপেক্ষা অনেক বড়।
পবিত্র কুরআনে যে কাজগুলো করা থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে তা পালন করা এবং এ ব্যাপারে অন্যকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য প্রতিটি মুসলমানের প্রতি জোর তাগিদ রয়েছে। এ সমস্যা মোকাবিলার জন্য সবচেয়ে বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া হচ্ছে প্রতিকারমূলক, প্রতিরোধমূলক ও পুনর্বাসনমূলক ব্যবস্থা।
ক.প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা বা পদক্ষেপ : মাদকাসক্তদের শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক অবস্থা বিচার বিশ্লেষণ তাদের সুস্থ
করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করাকে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা বলা হয়। আসক্ত ব্যক্তিদের প্রথমে তার পরিবেশ থেকে
সরিয়ে আনা হয়, যাতে সে আর পুনরায় মাদক গ্রহণ করার সুযোগ না পায়। পরে তাকে সুস্থ ও স্বাভাবিক করার জন্য কোনো
চিকিৎসা কেন্দ্রে ভর্তি করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়, যাতে ব্যক্তি পরিপূর্ণরূপে সুস্থ হয়ে তার হারানো ক্ষমতা ফিরে পায়
এবং স্বাভাবিকভাবে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। মাদকাসক্তি প্রতিরোধে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে।
খ. প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা : মাদকাসক্তির করাল ছোবল থেকে সমাজ ও সমাজের মানুষকে রক্ষা করার জন্য যেসব প্রয়োজনীয়
পদক্ষেপ বা কার্যক্রম নেয়া হয় তাকেই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা বলে। মাদকাসক্তি নিয়ন্ত্রণে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে
যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয় সেগুলো নিম্নরূপঃ মাদকাদ্রব্যের উৎপাদন ও আমদানি নিষিদ্ধকরণের লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সাথে সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণ করে প্রতিরোধ
ব্যবস্থা জোরদার করা। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পাঠ্যসূচিতে মাদকের ক্ষতিকর দিকগুলো অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে ব্যাপক ,সচেতনতা কার্যক্রম চালু করা।
বিভিন্ন সভা, সমিতি, সেমিনার, আলোচনা ও অন্যান্য প্রচার মাধ্যমগুলোতে প্রচারের মাধ্যমে মাদক প্রতিরোধের ব্যবস্থা করা। মাদক প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত আইনের বাস্তবায়ন করা। বাংলাদেশে মাদক চোরাচালানীতে আইন শৃংখলা বাহিনী , রাজনীতিবীদ জনপ্রতিনিধির সম্পৃক্ততার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। মাদকের বিরুদ্ধে মামলা বছরের পর বছর ধরে চলে। করোনা মহামারী চলাকালীনও অভিনব উপায়ে মাদক কারবারীরা এর ব্যবসা অব্যাহত রেখেছে। বিষয়টি উদ্বেগজনক। ফলে মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার জনিত সমস্যা আজ বিশ্বব্যাপী। অনৈতিকভাবে লাভজনক এ ব্যবসাকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক চোরাচালানী চক্র গড়ে উঠেছে। এ সমস্যার ভয়াবহতার কথা বিবেচনা করে জাতিসংঘের মহাসচিব বলেছেন, ‘এ বিশ্বকে মাদকমুক্ত করা এক বিশাল সমস্যা।’ বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এ ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষার জন্য মাদকাসক্তি নিরাময় ও প্রতিরোধ আন্দোলনে আপামর জনসাধারণকে এগিয়ে আসতে হবে। এর পূর্বশর্ত হিসেবে ধূমপান ও মাদকবিরোধী আন্দোলকে বেগবান করতে হবে। সরকারি মহল থেকে শুরু করে গণমাধ্যম, রাজনীতিবিদ, কুটনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, আইনজীবী, সমাজধর্মী, সমাজবিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদসহ সকল শ্রেণীর মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণপূর্বক মাদকমুক্ত বিশ্ব গড়ে তুলে এ বিশ্বকে সবার বাস উপযোগী করে তুলতে হবে।