admin || মুক্ত কলম সংবাদ
প্রকাশিত: ২৩ জুন, ২০২০ ৯:১৯ অপরাহ্ণ
নাগরিক ভাবনাঃ করোনা ও প্রবীনদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা, অ্যাডভোকেট আবু মহী উদ্দীনঃ বাংলাদেশের মানুষের বর্র্তমান গড় আয়ু ৭১ বছরেরও বেশী। আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধি, শিশু মৃত্যুর হার কমে যাওয়া , চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতি , নুতন নতুন উন্নত মানের ঔষধ আবিস্কার হওয়ার কারণে গড় আয়ু বেশী হয়েছে। মানুষের গড় আয়ু বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সারা দুনিয়ার সাথে প্রবীণদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, ১৯৯০ সালে বিশ্বে প্রবীণদের সংখ্যা ছিল ৫০ কোটি। বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১১০ কোটিতে। ২০৩০ সালে এর সংখ্যা হবে ১৫০ কোটি এবং ২০৫০ সালে প্রবীণদের সংখ্যা ২০০ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। আমরাতো গরীব দেশ। জাপানতো আর গরীব বা অনুন্নত কিংবা সভ্যতার ঘাটতি নাই। জাপান বর্তমানে বয়স্ক মানুষদের নিয়ে সমস্যায় পড়েছে। শুধু জাপান কেন সারা পৃথিবীর সরকারগুলো বিপদে আছে। বয়স্ক মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেশী। এর অধিকাংশই চিকিৎসা ব্যয়। মানুষের বয়স বাড়লে বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। ফলে স্বাস্থ্যগত সমস্যা সামাধাণে প্রচুর বিনিয়োগ করতে হয়। বর্তমান বাংলাদেশে প্রবীণদের সংখ্যা প্রায় দেড় কোটি। এর প্রায় ৫০ লাখ প্রবীণ অসুস্থ, অসহায়, অবহেলিত, নিঃসঙ্গ ও সেবাহীন জীবন যাপন করছেন। যাদের কারোরই করোনার ধাক্কা সামলানোর মতো শারীরিক মানসিক বা অর্থনৈতিক সামর্থ্য নেই।
আমাদের দেশে সরকার প্রবীনদের সহায়তা করার জন্য কিছু কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় তা খুবই অপ্রতুল। সরকারি কর্মচারীরা সরকারি চাকুরী শেষে পেনশন পান এবং প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল হলেও চিকিৎসা ভাতা পায়। এই ভাতাটি মাসে কমপক্ষে ১৫ হাজার টাকা হওয়া দরকার। অধিকাংশ বয়স্ক মানুষের , ডায়াবেটিস , উচ্চ রক্তচাপ , কিডনি , হার্ট , চোখ , প্রেষ্টেট গ্ল্যান্ডের সমস্যা হয়। কারো কারো আবার একাধিক সমস্যা এক সাথে থাকে। এসব রোগের চিকিৎসা ব্যয় খুব বেশী। এসব রোগের ঔষধের দামও বেশী । আবার চিকিৎসা পরামর্শের জন্য ঘন ঘন ডাক্তারের কাছে যেতে হয়। হাসপাতালে গিলে লাইন ধরা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়না। প্রাইভেট প্রাকটিশনারের কাছে গেলে পরামর্শ ফি বাবদ কমপক্ষে ৫০০ টাকা দিতে হয়। আমাদের হাসপাতালগুলোতে বয়স্ক মানুষদের আলাদা কোন ব্যবস্থা নাই। আমাদের চিকিৎসা বীমা ব্যবস্থা নাই। সরকারি কর্মচারীদের একটা হাসপাতাল আছে তা ঢাকা কেন্দ্রীক। জেলা / উপজেলা হাসপাতাল গুলোতেও একটা ব্যবস্থা থাকা দরকার। চিকিৎসা ব্যয় বৃদ্ধির কারণেই অধিকাংশ ছেলেমেয়েরা তাদের দায়িত্ব নিতে অনীহা প্রকাশ করে।
মহামারী করোনার আক্রান্তের মৃত্যুর হার প্রবীণদেরই বেশি। ডড়ৎষফঙগবঃবৎং এর তথ্য মতে, পৃথিবীর মোট মৃত্যুর প্রায় শতকরা ৭০ ভাগই প্রবীণ। এই দুঃসময়ে তাদের জীবন বাঁচানোর দায়িত্ব নেবে কে? প্রবীণ সংখ্যা দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে। এর ফলে একসময় শিশুর চেয়ে প্রবীণের সংখ্যাই হবে বেশি। এ সময় পরিচর্যাহীন বার্ধক্যই দেশের একটি প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে। বর্তমান সমাজে সবচেয়ে অবহেলার শিকার এখন অসহায় প্রবীণরাই। কিন্তু ক্রমবর্ধমান বার্ধক্যের অসহায়ত্ব মোকাবেলা করার মতো দরকারী প্রস্তুতি আমাদের নেই। ভবিষ্যতে করোনার মতো বিপর্যয় এলে তার জন্য প্রবীণদের উন্নয়ন প্রয়োজন। এখন থেকেই দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা অনুযায়ী কর্মসূচী বাস্তবায়নে সরকারী নীতিনির্ধারকদের এগিয়ে আসা একান্ত প্রয়োজন। করোনা মহামারী আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল স্বাস্থ্য ব্যবস্থাটা আমাদের দেশে কত নাজুক অবস্থায় আছে। এমনিতে বাজেটে বরাদ্দ কম। তার উপর যে টাকা দেওয়া হয়েছে তা গেছে , আফজাল , মিঠুদের পেটে। আফজাল মিঠুরা একাই কাজটা করেছে এমন ভাবার মতো বোকা দেশের মানুষ নয়। দেশের মানুষ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে আছে , দ্রুত এই চক্রের মুখোশটা উন্মুক্ত করুন। দেশের মানুষকে চিকিৎসা ব্যবস্থায় আস্থায় নিতে হবে। সম্প্রতি ব্যর্থতার জন্য স্বাস্থ্য সচিবকে সরানো হয়েছে বলে জানা গেল। স্বাস্থ্যমন্ত্রীতো সচিব ছিলেন , প্রমোশন পেয়ে মূখ্য সচিব হলেন। তাহলে তিনিতো শাস্তির বদলে পুরস্কার পেলেন। এখন তিনি হবেন ধোওয়া তুলশী পাতা।
অসহায় প্রবীণদের কল্যাণের বিষয়ে এখনই আমাদের উদ্যোগী হওয়া জরুরী। কেননা বার্ধক্য হচ্ছে মানুষের অবধারিত সমস্যা। আজকের নবীনই আগামী দিনের প্রবীণ। তাই শ্রদ্ধার সঙ্গে প্রবীণদের দেখভাল করতে হবে। আর এখন থেকেই নিজেদের স্বস্তিময় বার্ধক্যের প্রস্তুতি নিতে হবে। দয়া দাক্ষিণ্য বা করুণার দৃষ্টিতে নয়, মানবাধিকারের ভিত্তিতে এবং প্রাপ্য মর্যাদার যুক্তিতে প্রবীণদের চাওয়া-পাওয়া সমাধান করা প্রয়োজন। এর জন্য দরকার গণসচেতনতা। আর এই গণসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রবীণদের অবহেলা, অযত্ন, দুর্ব্যবহার, নির্যাতনের ঘটনা এবং সবার করণীয় বিষয়গুলো সব শিক্ষা পাঠ্য সূচিতে এবং গণমাধ্যম কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করতে পারলে প্রবীণদের প্রতি কিছুটা হলেও সম্মান প্রদর্শন করা হবে। আমাদের দেশে প্রতিটি জেলায় অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী কল্যান সমিতি আছে। তাদের সংস্থায় একজন খন্ডকালীন ডাক্তার নিয়োগ করার বন্দোবস্ত আছে। মন্দের ভালো তবু আছে। কিন্তু সরকারি কর্মচ্রাী আর কয়জন। ্এর বাইরে যারা আছেন তাদেরতো কোন উপায়ই নাই। আর যারা কোন চাকুরী করেননা তাদেরতো আর কিছু নাই। আবার উপজেলা পর্যায়ে কর্মচারী সমিতির অফিস নাই।
যে প্রবীণ যৌবনে তার মেধা, মনন, দক্ষতা দিয়ে সমাজের অনেক উন্নয়নমূলক কাজ করেছেন, জীবনের সকল সুখ বিসর্জন দিয়ে সন্তানদের মানুষ করেছেন, মানব কল্যাণে অবদান রেখেছেন, বৃদ্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই মানুষটি অযত্ন অবহেলার আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়। আপাতদৃষ্টিতে সমাজের বা সরকারের ন্যূনতম দায়িত্ব তাদের ওপর বর্তায় না। শিশুদের উজ্জ্বল ভবিষ্যত ও সুন্দর জীবন গড়ার জন্য পিতা-মাতা ও সরকারের যেমন দায়িত্ব আছে, অনুরূপ ভাবে প্রবীণদের জন্য সন্তান, সমাজ ও সরকারকে দায়িত্ব নিতে হবে। প্রবীণদের এই অসহায় দুর্দশা এড়িয়ে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। এর সমাধান না করলে প্রত্যেককেই বৃদ্ধ বয়সে এই অবহেলা ও কষ্টের স্বাদ নিতে হবে।
সরকার ইচ্ছা করলে প্রবীনদের জন্য চিকিৎসা সুবিধাটা বাড়ানোর জন্য প্রবীন হিতৈশী সংঘ জাতীয় সংগঠনকে পৃষ্টপোষকতা করতে পারে। তাদের মাধ্যমে সকল প্রবীনদের রেজিষ্ট্রেশন করে একটা ডাটাবেজ তৈরি করতে পারে। ডাটাবেজে বয়স্ক ব্যক্তির সকল তথ্য থাকবে।
একটা রেজিষ্ট্রেশন নম্বর থাকবে। দেশের সকল সরকারি / বেসরকারি হাপসপাতালে অনলাইনে এই ডাটা পাওয়া যাবে। তার সকল চিকিৎসা রেকর্ড থাকবে। তাদের জন্য ভিজিট ফ্রি অথবা নামমাত্র অর্থ ভিজিট দিয়ে তারা বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখাতে পারবেন। প্রতিটি হাসপাতালে ফার্মেসী থাকবে। ফর্মেসী থেকে তারা সাবসিডাইজ রেটে ঔষধ পাবেন। দেশের ব্যাংকগুলো সিএসআর খাতে অর্থ ব্যয় করে। এই খাতের একটা পরিমান অর্থ বাধ্যতামুলকভাবে প্রবীনদের চিকিৎসা সহায়তা খাতে ব্যয় করা যেতে পারে। তাহলে আমাদের প্রবীনদের জন্য একটা দায়িত্ব পালন করার সুযোগ সৃষ্টি হবে। করোনাকে মোকাবেলা করতে গিয়ে আমাদেও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দুর্বলতাগুলো নিশ্চয় চিহ্নিত হচ্ছে। আমরা বিশ^াস করি এবারে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার একটা উন্নয়ন ঘটবে। সে ক্ষেত্রে প্রবীনদের চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়নে নিশ্চয় পদক্ষেপ দেওয়া হবে।