admin || মুক্ত কলম সংবাদ
প্রকাশিত: ১৬ জুন, ২০২০ ৭:৪৭ পূর্বাহ্ণ
বাড়িভাড়া এখন অনেকের জন্য বড় বোঝা। ঢাকায় বাড়িভাড়া দিতে না পেরে পরিবারসহ গ্রামে ফিরে গেছেন, বাড়িভাড়া কমিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন বাড়িওয়ালা, অভিজাত এলাকা ছেড়ে অপেক্ষাকৃত কম ভাড়ার এলাকায় চলে যাচ্ছেন, ভাড়াটিয়ার অভাবে ফ্ল্যাটবাড়ি খালি পড়ে আছে, করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরুর পর থেকে মানুষের জীবনের এরকম নানা গল্প শোনা যাচ্ছে।
এসব ঘটনা নিয়ে কোন গবেষণা বা জরিপ হয়নি কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে অনেকেই এর মুখোমুখি হচ্ছেন। বাড়িওয়ালাদের উপর নানা কারণে ভাড়াটিয়াদের ক্ষোভ নতুন নয়। কিন্তু করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরুর পর থেকে ভাড়াটিয়া-বাড়িওয়ালা দুই পক্ষই বিপদে পড়েছেন।
গ্রামে ফিরে যাওয়ার গল্পঃ টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার মুস্তাফিজুর রহমান কিছুদিন আগে পরিবারসহ ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়িতে গেছেন। এই যাওয়ার সঙ্গে অন্য সময়ের একটা বড় পার্থক্য রয়েছে। এবার তিনি ঢাকার কুড়িল এলাকার ভাড়াবাড়ি ছেড়ে দিয়ে, সকল আসবাবপত্র সমেত পুরোপুরি গ্রামে ফিরে গেছেন।সাধারণ ছুটি শিথিল করার পর গ্রামে ফেরার জন্য মানুষের ঢল।
তিনি বলছেন, “তিন মাস বেতন পাইনি। খরচ কমানোর জন্য শুরুতে আমার স্ত্রী ও ছেলেকে গ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। এরপর এই করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও বাড়িওয়ালা ভাড়া বাড়াতে চাইলো। বাসা ভাড়া দিতাম ১২ হাজার টাকা আর বেতন ছিল ২২ হাজার। চাকরি নেই, তিনমাস বেতন পাইনি, এত বাড়িভাড়া কোথা থেকে দেবো। দেখলাম আর পারা যাচ্ছে না। মুস্তাফিজুর রহমান এখন পটুয়াখালীর মীর্জাগঞ্জে বাবার বাড়িতে থাকছেন। ঢাকায় আর ফিরবেন কিনা নিশ্চিত নন। তিনি বলছেন, আব্বা আম্মা বলছেন, এত বাড়িভাড়া টানতে হবে না। আমাদের যা আছে সেটা দিয়ে কোনরকমে সবাই মিলে একসাথে বেঁচে থাকতে পারলেই চলবে। আমাদের এত টাকা পয়সার দরকার নেই। শুধু মুস্তাফিজুর রহমানের মতো নিম্নবিত্ত নন, মধ্যবিত্তদেরও বাড়িভাড়ার খরচ যোগাতে বেগ পেতে হচ্ছে।
বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরুর পর ৬৬ দিন সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটি ছিল। সেসময় বন্ধ ছিল কলকারখানা, সকল ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার কঠোর নির্দেশনার কারণে অচল হয়ে পড়েছিল অর্থনীতির চাকা যা এখনো পুরোপুরি সচল হয়নি। দিনমজুর থেকে শুরু করে বড় বেতনের চাকুরে সবার জীবনেই কোন না কোন ভাবে এর প্রভাব পড়েছে। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি বলছে, সাধারণ ছুটির ৬৬ দিনে ছাঁটাই, প্রতিষ্ঠান বন্ধ এবং কর্মহীনতা এসব কারণে দেশে চাকরি হারিয়েছেন প্রায় তিন কোটি ৬০ লাখ মানুষ।অনেক বাড়িওয়ালা বাধ্য হয়ে কম ভাড়া নিয়েছেন।
ঢাকায় বাড়িভাড়া কমেছে?
ঢাকায় বাড়ি ভাড়া কমে গেছে এরকম তথ্য শুনে হয়ত অনেকেই খুব খুশি হবেন। কিন্তু এর পেছনে এখন যেসব গল্প শোনা যাচ্ছে তা বোধহয় খুশি হবার মতো নয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পশ্চিম ধানমন্ডির একজন ভাড়াটিয়া বলছেন, আমি করোনা ভাইরাসের কারণে মাকে ঢাকায় নিয়ে এসেছি সেজন্য একটু বড় ফ্ল্যাট খুঁজছিলাম। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করে আমার এক বন্ধু জানালো যে সে ধানমন্ডিতে তার তিন রুমের ফ্ল্যাট ছেড়ে দিচ্ছে। সে ২৪ হাজার টাকা ভাড়া দিত। এখন সে ১২ হাজার টাকায় মোহাম্মদপুরে বাসা নিয়েছে। আর আমি একই ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছি ১৮ হাজার টাকায়। এই ঘটনার আরেকটি অংশ হল তিনি এই ফ্ল্যাটটি কম ভাড়ায় পেয়ে গেলেন। তিনি বলছেন, বাড়িওয়ালা তাকে বলেছিল যে আপনার যাওয়ার দরকার নেই। আমি ১৮ হাজার টাকা পর্যন্ত ভাড়া কম নিতে পারবো। কিন্তু তার পক্ষে সেটাও দেয়া সম্ভব হয়নি। এখন বাসা বদলাচ্ছেন না কেউ। তাই নতুন ভাড়াটিয়া না পাওয়ার শঙ্কায় এরকম অনেক বাড়িওয়ালা ভাড়া কম নিতে রাজি হচ্ছেন।দিনমজুর থেকে শুরু করে বড় বেতনের চাকুরে সবার জীবনে প্রভাব পড়েছে।
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে মানুষজনের আয়ে যে প্রভাব পড়েছে সেই বিবেচনায় বাড়িভাড়া কমানোর দাবি জানিয়েছিল কয়েকটি নাগরিক সংগঠন। বাড়িভাড়া মওকুফের দাবিতে ঢাকায় মানববন্ধনও হয়েছে। নানান আকারের দশটি ফ্ল্যাট আছে ঢাকার মগবাজারে এমন একটি বাড়ির মালিক রাজিয়া সুলতানার পরিবার। তিনি বলছেন, আমার দুইজন ভাড়াটিয়ার অনুরোধে দুই হাজার টাকা করে ভাড়া কমিয়ে দিতে হয়েছে। আর নিচের তলায় একটা বিউটি পার্লার আছে তারা তিনমাস ভাড়াই দিতে পারেনি। তারা বাসাটাও ছাড়েননি। আমি তাদের এরকম সময়ে কিছু বলতেও পারছি না। তিনি বলছেন, তাকে এখন তার মেয়ের স্কুলে একসাথে চারমাসের বেতন দিতে হবে। বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাসের বিল জমে গেছে। সেটাও দিতে হবে।
এপ্রিলের মাঝামাঝি সময় ব্র্যাক একটি জরিপের ফল প্রকাশ করেছে যাতে দেখা গেছে, করোনাভাইরাসের প্রভাবে তখনই মানুষের আয়-রোজগারে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।ভাড়া দিতে পারেননি অনেক ভাড়াটিয়া। আড়াই হাজার মানুষের উপর করা জরিপ খুব বড় আঙ্গিকের নয় তবুও জরিপে অংশ নেয়া ব্যক্তিদের উত্তরের ভিত্তিতে দেখা যাচ্ছে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরুর পর যে সাধারণ ছুটি ছিল তাতে এই অংশগ্রহণকারীদের ৯৩ শতাংশের আয় কমে গেছে।
খালি পড়ে আছে ফ্ল্যাটঃ মিরপুরের একজন বাড়িওয়ালা বলছেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে আমার একটা ফ্ল্যাট খালি হয়েছে। সেটা আর ভাড়াই দিতে পারিনি। আমাদের মতো পরিবারও শেষ পর্যন্ত আক্রান্ত হচ্ছে।
তিনি এখন যা পান তাতেই ভাড়া দেয়ার পরিকল্পনা করছেন কারণ বাড়িটি বানাতে তাকে ঋণ নিতে হয়েছে। সেটা শোধ করার পাশাপাশি তার নিজের সংসারও চলে বাড়িভাড়া দিয়ে।