মোক্তারুজ্জামান মোক্তার,পার্বতীপুর,দিনাজপুর প্রতিনিধি || মুক্ত কলম সংবাদ
প্রকাশিত: ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৫ ১১:৩৪ পূর্বাহ্ণ
আজ ১৫ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালের এই দিনে পার্বতীপুর হানাদার মুক্ত হয়ে ছিল । ১৯৭১ সালের ৮ এপ্রিল খোলাহাটি ও বদরগঞ্জ রেল লাইনের দক্ষিণে রামকৃষ্ণপুর, বাগবাড় ও পেয়াদাপাড়ায় পাকসেনারা ৩০০ লোককে হত্যা করে এবং ঘর-বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। উপজেলার মুক্তিযোদ্ধারা খোলাহাটি রেলস্টেশনের পাশে করতোয়া নদীর উপর রেলব্রিজ অপারেশন, ভবানীপুর রেলস্টেশনের দক্ষিণ পাশে শাহগ্রাম রেলব্রিজ অপারেশনে এবং হাবড়া, দেউল, মধ্যপাড়া, রামপুর প্রভৃতি স্থানে ছোট ছোট অপারেশন পরিচালনা করে। উপজেলার রহমতনগরে ১টি গণকবর রয়েছে, তিনজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নামে ইব্রাহিম নগর, আব্বাস নগর ও মোজাফফর নগরের নামকরণ করা হয়েছে।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ যখন সারা দেশে স্বাধীনতাকামী আন্দোলন শুরু করে ছিল ঠিক তখনই পার্বতীপুর শহরে আইন তোয়াক্কা না করেই আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়ে দামাল ছেলেরা। ফলে এখানে ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালতের কাজ ভেংগে পড়ে ।
পার্বতীপুর শহরে বসবাসরত অবাঙালিদের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ শহর ঘেরাও করে জাহানাবাদ এলাকায় অগ্নিসংযোগ করে ঘরবাড়ি পুড়ে সাধারণ মানুষের। এ সময় বাঙালিদের ওপর ব্যাপক গুলিবর্ষণ করে অবাঙালিরা। প্রাণের ভয়ে পালিয়ে ও রক্ষা পায়নি মামুনপাড়া গ্রামের ফচি হাজি। উপজেলার কালাই ঘাটির রইচ উদ্দিন, বেলাই চন্ডির মোজাম্মেল হক ও শফি কচুয়াপাড়ার ভেলসা প্রমুখ।
এছাড়াও ২৪ ও ২৫ মার্চ পার্বতীপুর থানার এ এস আই গোলামের পরিবারের সদস্যরা, স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মচারী ইমাম মোল্লাসহ ১১ জন, এম আহাম্মেদের চার কর্মচারী, কাশিয়া পরিবারের চার সদস্য, ক্যাপ্টেন ডাক্তারের ছেলে শামসাদ এবং হাবড়া ইউনিয়নের ভবানীপুর থেকে আব্দুল হাকিমকে কয়লার বয়লারে জীবন্ত নিক্ষেপ করে পুড়িয়ে হত্যা করে।
এ গণহত্যার পর পার্বতীপুরে বসবাসরত বাঙালিরা ক্রোধে ফুঁসে উঠে। ২৬ মার্চ সারা দেশে যুদ্ধ শুরু হয়। ২৯ মার্চ শহরের পুরাতন বাজারের উপেন চন্দ্রশীল ও সুভাষ চন্দ্র শীলসহ ১৪ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করে লাশগুলো বাড়ির একটি কুয়ার মধ্যে ফেলে দেয়। ১ এপ্রিল সংগ্রামী যুবক দল বৃত্তিপাড়ার কাছে মটার বসিয়ে সন্ধ্যায় একযোগে চতুর্মুখী আক্রমণ চালায়। শেষ রাতে হঠাৎ কামান গর্জে উঠে ও তুমুল গোলাগুলি শুরু হয়।
পার্বতীপুর শহরের সোয়েব বিল্ডিংয়ের ওপর প্রথম শেল নিক্ষিপ্ত হয়। ২ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনা ও অবাঙালিরা হিংস্রতায় উন্মুক্ত হয়ে পার্বতীপুরের পাঁচ বর্গকিলোমিটার জনপদে অগ্নিসংযোগ, লুট, হত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতন চালায়। ৮ এপ্রিল সবচেয়ে বৃহৎ গণহত্যার ঘটনা ঘটায় পাকিস্তানি বাহীনি। রংপুর থেকে পাকিস্তানি সেনারা ট্রেনে করে এসে বদরগঞ্জে পশ্চিমে ব্রিজের কাছে নামে।
অন্যদিকে ১০ নম্বর ইউনিয়নের পূর্ব হোসেনপুর গ্রামের আজিজার রহমান চৌধুরী ও তার ভাই মতিয়ার রহমানকে একই সঙ্গে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করে। চাঁচেয়া গ্রামের সহির উদ্দিন, দলাই কোঠা গ্রামের মো. শাহাবুদ্দিনকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায় সেনারা এবং পরদিন খয়েরপুকুর হাটের কাছে তাদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করে।
১৩ ডিসেম্বর ভবানীপুর, হাবড়া, বেলাইচন্ডি, খোলাহাটি ও হরিরামপুর এলাকার সেনাক্যাম্প, রাজাকার ক্যাম্পগুলো মুক্তিযোদ্ধারা দখলে নেওয়া শুরু করে। ১৪ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্র বাহিনীর যৌথ হামলায় পাকিস্তানি সেনা, রাজাকার ও অবাঙালিরা বিশেষ ট্রেনযোগে পার্বতীপুর থেকে সৈয়দপুরের দিকে পালিয়ে যেতে থাকে। ১৫ ডিসেম্বর রাত ১২টার পরে মুক্তিযোদ্ধারা মুক্তিকামী হাজার হাজার মানুষকে সঙ্গে নিয়ে পার্বতীপুর শহরে প্রবেশ করে, মানুষে মানুষ ভরিয়ে যায় পার্বতীপুর শহর। আর এভাবেই মুক্ত হয় হানাদারের হাত থেকে পার্বতীপুর।