ডা: নূরল হক,বিরামপুর প্রতিনিধি: মাদকাসক্তি কথাটার মানে হচ্ছে মাদকের প্রতি আসক্তি। মানুষের যেকোনো জিনিসের উপর ভালোবাসা ভালোলাগা থাকতেই পারে। কেউ মোবাইলে, কেউ ফেসবুক, কেউ টিভি সিরিয়ালে, ছোট ছোট শিশুরা মোবাইলে গেম খেলা, টিভি দেখে খাওয়ানো ইত্যাদিতে।
এই ভালোলাগা, ভালোবাসা অতিরিক্ত ভাবে যখন অভ্যাসে পরিণত হয়ে উঠে তখন সেটাই আসক্তি হিসেবে চিহ্নিত হয়। এই আসক্তি যখন দৈনন্দিন জীবনের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে তখন তা ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
সেরূপ মাদক একটি আসক্তি। মূলত মাদক এক ধরনের কেমিক্যাল। অনেক সময় একজন চিকিৎসক বেদনা নাশক বা চেতনা নাশক হিসেবে এমন কিছু ওষুধ প্রেসক্রাইব করে থাকেন যা মাত্রার অতিরিক্ত সেবনের দ্বারা একজন মানুষ নেশাগ্রস্ত হতে পারে। মাদক সেবনকারি মাদক সেবন করতে করতে যখন এমন একটা পর্যায়ে উপনীত হয় সেখান থেকে ফিরে আসা অনেক ক্ষেত্রে অসম্ভব হয়ে ওঠে।
এতে একজন মাদক সেবীর নিজের জীবনের উপর প্রভাব পড়ে এবং তার অন্যান্য নিয়মিত কাজ ব্যাহত করে যাকে বলা যেতে পারে মাদকের কু -প্রভাব। তখন সে মাদক আসক্তিতে পরিণত হয়। সেখান থেকে ফিরে আসা অসম্ভব হয়ে ওঠে ।
সাধারণত মাদক সেবনের আগ্রহ নিজের কৌতুহল বা বন্ধু-বান্ধবের পাল্লায় পড়ে অথবা যদি কোন পরিবারের বাবা মাদক সেবন করে সে ক্ষেত্রে সন্তান দেখছে বা জানে তখন তার মধ্যে একটা মাদক সেবনে আগ্রহ জেগে ওঠে। অনেক সময় হতাশা, অশান্তি, মানসিক চাপ, বেকারত্ব, পারিবারিক অশান্তিতে ইত্যাদি মাদকের প্রতি আগ্রহ জাগিয়ে তুলতে পারে। অনেক সময় শখের বসে এক- দুদিন বা কিছুদিন মাদক সেবনের পর মাদকের প্রতি একজন মানুষ আসক্ত হয়ে পড়তে পারে।
এছাড়াও জেনেটিক একটা বিষয় রয়েছে। এখানে জেনেটিক বলতে বংশগত নয় বরং এটি একটি জিনগত সমস্যা। যে ব্যক্তির ভিতরে জিনগত সমস্যা বিদ্যমান সে মাদকের প্রতি অতিমাত্রায় সংবেদনশীল হয়ে থাকে। একবার যদি সে মাদক সেবন করে তাহলে মাদক তাকে বারবার টানবে, সেক্ষেত্রে তাকে ফেরানো কঠিন হয়ে পড়ে। এ ধরনের মানুষের সংখ্যা শতকরা ১০ জন। এজন্য পরিবারকে সচেতন থাকতে হবে তাদের সন্তান যেন প্রথম থেকে মাদকের ধারের কাছে যেতে না পারে।
মাদকের শুরুটা হয় সিগারেট বা ধূমপান দিয়ে। সিগারেট একটি ভয়ঙ্কর মাদক। মাদকের প্রবেশদ্বার সিগারেট। বাংলাদেশে গড়ে এক চতুর্থাংশ লোক ধূমপান করে অথচ এটাকে হালকা ভাবে ধরা হয়। এছাড়া রয়েছে গাঁজা, বাংলা মদ, অ্যালকোহল, স্পিরিট, হিরোইন, ফেন্সিডিল, ইয়াবা ইত্যাদি নানান মাদক। এক সময় হিরোইন ও ফেনসিডিল সেবনের প্রবণতা ছিল বেশি। এখন হেরোইন ও ফেন্সিডিল সেবনের হার অনেক গুণ কমে গেছে। তবে গাঁজা ও ইয়াবা- সেবনের প্রবণতা বাড়ছে।
তথ্য সূত্রে জানা যায় ,দেশের প্রায় এক কোটি মানুষ বিভিন্ন রকমের নেশায় আসক্ত – যার মধ্যে ৫০ লক্ষ মানুষ ইয়াবা আসক্ত। জনসংখ্যাকে জনসম্পদে পরিণত করার অন্যতম প্রধান অন্তরায় মাদকাসক্তি। মাদক সেবনের ফলে মানুষের পা থেকে মাথা পর্যন্ত প্রায় প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বেশি আক্রান্ত হয় যেমন ধূমপানের কারণে গলায় ক্যান্সার, মুখের ক্যান্সার, ফুসফুসে ক্যান্সার, হাঁপানি ও ব্রংকাইটিস হতে পারে । এছাড়া অন্যান্য মাদক সেবনে মস্তিষ্কে ও হৃদপিন্ডের রক্ত সরবরাহ কমে যায়, স্ট্রোক হওয়া সম্ভাবনা থাকে, কিডনির কার্যক্ষমতা হ্রাস পায়, লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং পরিপাকতন্ত্র আক্রান্ত হয়। সারা বিশ্বে মাদকাসক্তিকে একটি মস্তিষ্ক জনিত রোগ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
মাদকাসক্তি ব্যক্তিকে চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। এর জন্য দেশের বিভিন্ন স্থানে মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র রয়েছে। বেশিরভাগ মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে মানসম্মত চিকিৎসা না থাকায় মাদকাসক্তি ব্যক্তিকে নিরাময় করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। তবে মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসা ব্যবস্থা আরো মানসম্মত হওয়া প্রয়োজন। কারণ অনেক মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে মনোরোগ চিকিৎসক, সাইকোলজিস্ট, সাইকোথেরাপি, ফিজিওথেরাপি এ ধরনের কোনো চিকিৎসক নেই।
আর এই ধরনের চিকিৎসক ছাড়া একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে পূর্ণাঙ্গ সুস্থ করা সম্ভব নয়। তবে বাংলাদেশ পুলিশ কল্যাণ ট্রাস্টের তত্ত্বাবধানে ঢাকা দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে “ওয়েসিস ” নামে একটি অত্যাধুনিক মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র নির্মিত হয়েছে সেখানে মানসম্মত উন্নত চিকিৎসার মাধ্যমে মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে নিরাময় করা সম্ভব হয়ে ওঠে।